অপরূপ সুন্দর সাজেক ভ্যালি যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবি; source: offroadbangladesh.comচারিদিকে সারি সারি পাহাড় আর মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মত মেঘমালা। যেন
সবুজের রাজ্যে সাদা মেঘের হ্রদের পাড়ে দাড়িয়ে আছেন আপনি। নিশ্চয়ই ভাবছেন
স্বপ্নের মত সুন্দর এরকম দৃশ্য বাস্তবে আদৌ কি দেখা যাবে? আর দেখা গেলেও
হয়ত যেতে হবে বহুদূরে কোন অজানা দেশে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল আমাদের
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেই রয়েছে এরকম এক মেঘপুরী যার নাম সাজেক ভ্যালী।
সাজেক
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত। সাজেক থেকে
ভারতের মিজোরাম মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। সাজেকের চারপাশের উঁচু উঁচু
পাহাড়গুলো পড়েছে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই। তবে ঢাকা থেকে সাজেক যেতে হলে
আপনাকে প্রথমে যেতে হবে ঢাকা থেকে ২৬১ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি শহরে।
যেভাবে যাবেন খাগড়াছড়ি
সাজেকের অবস্থান রাঙ্গামাটি পার্বত্য
জেলায় হলে খাগড়াছড়ি শহর থেকেই সেখানে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। তাই সাজেক
যেতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে চলে যেতে হবে খাগড়াছড়ি শহরে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি
রুটে শ্যামালী, হানিফ, এস আলম, সৌদিয়া ও শান্তি পরিবহনের বাস চলাচল করে।
গাবতলী, কলাবাগানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে পরিবহণগুলোর
কাউন্টার। ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে চট্রগ্রাম রোড হয়ে কুমিল্লা, ফেনী পার হয়ে
চট্রগ্রামের মিরেসরাই হয়ে খাগড়াছড়ি শহরে পৌছায়। এতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টার মত।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক
আপনাকে
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যেতে হবে খোলা জীপে করে। যা চান্দের গাড়ি নামেই
পরিচিত। দুই দিনের জন্য ভাড়া করলে আপনাকে গুনতে হবে ৭০০০-৯০০০ টাকা।
চান্দের গাড়িতে আসন সংখ্যা ১২টি। সাজেক থেকে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে
দীঘিনালায়। দীঘিনালা নেমে আধা ঘন্টার জন্য ঘুরে আসতে পারেন হাজাছড়া ঝর্ণা
থেকে। সাথে সেরে নিতে পারেন গোসলটাও। কারণ সাজেকে পানির বড্ড অভাব। তবে
চিন্তার কিছু নেই গোসল ও অন্যান্য কাজের জন্য দরকারি পানি প্রতিদিন ট্রাকে
করে পৌঁছে যায় সাজেকে।
তবে পানি ব্যবহারে সাজেকে আপনাকে মিতব্যয়ী হতে
হবে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। দীঘিনালায় একটি
সেনানিবাস রয়েছে। এরপর বাকি রাস্তাটুকু আপনাকে যেতে হবে সামরিক বাহিনীর
এসকোর্টে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তার
স্বার্থে সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নিয়েছে। দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট
শুরু হয় সকাল ১০ টা থেকে ১১টার মধ্যে। তাই ঐ সময়ের আগেই আপনাকে পৌঁছে যেতে
হবে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায়। নইলে একবার সকালের এসকোর্ট মিস করলে আবার
এসকোর্টে পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিকেল অবধি।
দীঘিনালা থেকে প্রথমে
যেতে বাগাইহাট, তারপর মাচালং হাট হয়ে সরাসরি পৌঁছে যাবেন সাজেকে। খাগড়াছড়ি
শহর থেকে সাজেক যেতে মোট সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘন্টার মত। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি
রাস্তাধরে চলা এই ছোট জার্নিটি সাজেক ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ। চারদিকে শুধু
পাহাড় আর হরিতের সমারোহ আপনাকে ভুলিয়ে দেবে পথের ক্লান্তি।
সাজেকে থাকা খাওয়া
সাজকে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর একটার মত বেজে যায়
তাই পৌঁছানোর সাথে সাথে আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে রাতে থাকার কটেজ। বিভিন্ন
দামের ও মানের কটেজের অভাব নেই সাজেকে। হানিমুনে গেলে যেমন আলিসান কটেজে
থাকতে পারবেন আবার খরচ কমাতে চাইলে ভাল মানের সাশ্রয়ী কটেজেরও অভাব নেই।
জনপ্রতি ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা অবধি কটেজগুলোর এক রাতের খরচ।
সাজেকে
আদিবাসী ও বাঙ্গালি দুই রকমের হোটেলে খাবার ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছা করলে
আদিবাসী হোটেলগুলো থেকে ব্যাম্বু চিকেনের স্বাদ নিয়ে আসতে পারেন । তবে যারা
হালাল খাবার খুজছেন তাদের হয় খাগড়াছড়ি থেকে হালালভাবে জবাই করে মুরগি নিয়ে
যেতে হবে না হয় নিজেদের জবাই করে দিতে হবে। তবে বাঙালি হোটেল খাওয়া দাওয়া
করলে সে চিন্তা আপনাকে করতে হবেনা। তবে মুরগি ছাড়া ডিম, ডাল, ভর্তা সহ
অন্যান্য ননভেজ খাবারও পাওয়া যায় সাজেকে। তবে যেখানেই খান না কেন আপনাকে
আগে থেকে অবশ্যই অর্ডার করে রাখতে হবে খাবারের কথা। বিশেষ করে সাজকে
পৌঁছানোর দিন দুপুরের খাবারাটা খাগড়াছড়ি থেকেই অর্ডার করে গেলে সুবিধে হয়।
আপনার জীপ চালকেরই মাধ্যমেই তার পরিচিত কোন দোকানে খাবারের অর্ডার করিয়ে
নিতে পারেন। আরেকটি কথা সাজেকে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সবকিছু চলে সোলারে
পাওয়ারে। তাই আগে থেকেই মোবাইল ফুলচার্জ দিয়ে নিয়ে যাওয়া ভাল। সাথে পাওয়ার
ব্যাঙ্ক থাকলে তো সোনায় সোহাগা। সাজেক রবি ও টেলিটক ছাড়া অন্য অপারেটরর
নেটওয়ার্ক নেই। তাই সাথে নিতে হবে এই দুই অপারেটরের যেকোন একটি সিম।
সাজেক বিলাস করবেন যেভাবে
সাজেক পৌঁছে খাওয়া দাওয়া করার পর
দীর্ঘ যাত্রার শেষে আপনাকে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে। এছাড়া সাজেকের কাঠফাটা
দুপুরের রোদে না ঘোরাঘুরি করে রোদ পড়ার অপেক্ষা করাই ভাল। বিকেলে জীপে করে
আপনি ঘুরে আসতে পারেন সাজেক ভ্যালির আরও ভেতরে। সেখানে একটু উঁচু টিলায়
উঠলেই উপভোগ করতে পারবেন সূর্যাস্ত। সাজেকের সন্ধ্যা নামে অপরূপ এক
সৌন্দর্য নিয়ে। দেখবেন মেঘমুক্ত নীলাকাশ একটু একটু করে অন্ধকারে আচ্ছন্ন
হয়ে যাচ্ছে আর মিটিমিটি করে জ্বলে উঠছে একটি দুটি করে তারা। দেখবেন
অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে একটি দুটি থেকে সহস্র তারা আপনার চোখের সামনে
জ্বলজ্বল করে উঠবে। হয়ত আপনি এরকম তারা ভরা আকাশ জীবনে কখনও দেখেন নি।
সন্ধ্যার
তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিলে আপনার
হৃদয়ে যে অনুভূতি আসবে সেটাই হতে পারে আপনার সাজেক ভ্রমণের সবচেয়ে বড়
আনন্দ। যারা তারা দেখতে ভালবাসেন তাদের জন্য সাজেক খুবই আদর্শ একটি জায়গা।
এমনকি যারা এখনও মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দেখেননি তারাও সাজেক
ভ্যালিতে এসে জীবনে প্রথমবারের মত দেখা পেতে পারেন মহাবিশ্বে আমাদের
আশ্রয়স্থল আকাশগঙ্গার।
রাতে চাইলে বারবিকিউ পার্টি করতে পারেন। সাথে চলবে জমপেশ আড্ডা। তবে এত
আনন্দের মাঝে মশার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে ভুলবেন না। পার্বত্য এলাকায় মশা
একটি বড় সমস্যা। একটু অসতর্ক হলে আক্রান্ত হতে পারেন ম্যালেরিয়ায়। ভোরে
সূর্যোদয় দেখতে চাইলে হ্যালিপ্যাডে চলে যাবেন অবশ্যই। সেজন্য উঠতে হবে খুব
ভোরে আর চলে যেতে হবে এক বা দুই নম্বর হ্যালিপ্যাডে। সাজেকে সূর্যোদয়ের সময়
সোনালি আভা সাদা মেঘের উপর যখন ঠিকরে পড়ে তখন আসাধারণ এক দৃশ্যের অবতারণা
হয়।সচরাচর সাজেক একরাতের বেশি থাকার প্ল্যান নিয়ে কেউ যায়না। তবে বেশি ভাল
লেগে গেলে থেকে যেতে পারেন যতদিন খুশি। ফেরার দিনও আপনাকে এসকোর্ট ধরতে
হবে। সাজেকে থেকে এগারটার দিকে শুরু হয় এসকোর্ট। খাগড়াছড়ি ফিরতে ফিরতে
দুপুর হয়ে যাবে। তবে চাইলে দুপুরে বেশি সময় নষ্ট না করে ঘুরে আসতে পারেন
আলুটিলা ও শহরের আশে পাশের দর্শনীয় স্থানগুলো থেকে।
আলুটিলা রহস্যগুহা
খাগড়াছড়ি
শহরে এসে আলুটিলা রহস্য গুহায় যেতে অবশ্যই যেন ভুলবেন না। শহরের অদূরে
আবস্থিত এই গুহায় বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা হবে আপনার মাত্র মিনিট পনেরর একটি
ভ্রমণে। যেন মনে হবে ইন্ডিয়ানা জোন্সের মত আপনিও অংশ নিচ্ছেন কোন রোমাঞ্চকর
অভিযানে। গুহার ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই টর্চ বা বাঁশের মশাল সাথে নিয়ে
যেতে হবে। চিন্তা করবেন না গুহার বাইরেই মশাল কিনতে পাওয়া যায়।
আলুটিলা যাওয়ার পথেই চান্দের গাড়ির চালককে বললে সে ঘুরিয়ে আনবে কাছের টিলার
উপর থেকে। পুরো খাগড়াছড়ি শহরের ভিউ এখান থেকে পাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি শহরে
একটি ছোট্ট ঝুলন্ত সেতু আছে। চাইলে দেখে আসতে পারেন সেটিও আর সারাদিনের
ক্লান্তির অবসান ঘটাতে সাঁতরে আসতে পারেন নিচের খাল থেকে। রাতেই ধরতে পারেন
ঢাকাগামী বাস। কথা দিচ্ছি দুইদিনের এই সাজেক ট্যুর আপানর মন্দ কাটবেনা।
অপরূপ রূপে শোভিত আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। একদিকে বিস্তীর্ণ সমতল
অন্যদিকে সাগর ও পাহাড়। কি নেই আমাদের দেশে? এইদেশের প্রতিটি জেলাই যেন এক
একটি পর্যটন কেন্দ্র। তাই ভ্রমণ পিয়াসি মানুষের আনাগোনাও দিন দিন বেড়ে চলছে
এইসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল পর্যটকদের অসতর্কতা
এবং বে খেয়ালীপনায় অনেক জায়গাতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাই যেকোন
ভ্রমণে চিপসের প্যাকেট, জুসের ক্যানসহ নানা ময়লা আবর্জনা যথাযথ জায়গা ফেলার
দিকে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত নয়তো আগামী প্রজন্ম বঞ্চিত হবে এই মনোরম
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে।
No comments:
Post a Comment