আমরা চার ভাই গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামের বাস টার্মিনাল থেকে ভোর ৬.১০ মিনিটে পূর্বাণী এবং ৬.৩০ মিনিটে পূরবীর প্রথম গাড়ি ছাড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। ভোরের প্রথম গাড়িতে গেলে দু ঘণ্টারও কম সময় লাগবে। কেরানীহাটের পর বান্দরবান যাওয়ার রাস্তায় কমপক্ষে ১০-১২টি জায়গায় উন্নয়ন কাজ চলায় আমাদের দু ঘণ্টা লেগেছিল বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড পৌঁছাতে। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি কিংবা মাহিন্দ্রা নিয়ে যাওয়া যায় নীলগিরি। আমরা যেহেতু একদিনের জন্য গিয়েছিলাম, তাই সময়ের ব্যাপারটা মাথায় রাখা খুবই জরুরি ছিলো আমাদের।
মাহিন্দ্রা সারাদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলাম। সেখানে অনায়াসে পেছনে চারজন এবং সামনে একজন বসা যায়, পাহাড়ি রাস্তায় সামনে দু'জন বসলে ঝুঁকি থাকে তবে বাজেট সঙ্কট হলে সামনেও দু'জন বসতে পারেন চাইলে। ভাড়া নিয়েছিল দিনশেষে ২৯০০ টাকা, যদিও ২৫০০তেই যাওয়া সম্ভব। আমরা তেমন দামাদামি করিনি।
বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের প্রথম যাত্রা ছিল নীলগিরি। দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার। একই রাস্তা দিয়েই থানচি এবং রুমা যেতে হয়। রুমার রাস্তা ধরেই বগালেকের ঠিকানা খুঁজতে হয়। নীলগিরির পথে দু'বার চেকপোস্ট পড়বে। একবার মিলনছড়িতে পুলিশ চেকপোস্ট এবং আরেকবার সায়রুর আগে সেনাবাহিনী চেকপোস্টে নিজেদের নাম ঠিকানা সব জানাতে হবে। বান্দরবান ভ্রমণে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে আসবেন। অবৈধ কোনো বস্তু, বিশেষ করে মাদক নিয়ে ভ্রমণ করা যাবে না।
মিলনছড়ি চেকপোস্টে আকাশ ও মেঘের মিতালী আপনাকে আবেগতাড়িত হতে বাধ্য করবে। শুভ্র মেঘে পাহাড় ঢেকে যাওয়া দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। ক্যামেরায় এই দৃশ্যগুলো বন্দী করতে ভুলবেন না, যদিও ক্যামেরার চেয়েও খালি চোখে হাজারগুণ সুন্দর। দূর থেকে দেখে মনে হবে, কোনো চিত্রশিল্পী তার রঙতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন পাহাড়ের বুকে মেঘের খেলা। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি অপরূপভাবে ধরা পড়ে সেখানে।
মিলনছড়ি থেকে পুলিশ চেকের পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। সায়রুতে সেনাবাহিনীর চেকের পর মাঝরাস্তায় স্বেচ্ছায় আরেকবার দাঁড়িয়েছিলাম নিজেদের ফটোশ্যুটের জন্য। রাস্তের দু-ধারেই পাহাড়, পাহাড়ের বুকে অসংখ্য কলাগাছের চাষ হয়। সায়রু হিল রিসোর্টের পর বিশাল একটা রাস্তা, নেই কোনো রিসোর্ট বা জনবসতি। খাঁ খাঁ করে পুরো এলাকা। পথিমধ্যে পরিশ্রমী পাহাড়ি মানুষদের দেখা যায়, যারা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে যায়, যখন গাড়ি তাদের অতিক্রম করে যায়। অনেকেই পাহাড়ে চাষবাস করে, তাই দা-কোদাল হাতে তাদের দেখা যায়। এতে ভয় পাবার কিছু নেই।
এক লেনের রাস্তায় তীব্র গতিতে ছুটে যায় চান্দের গাড়ি। আপনার গাড়িকে অতিক্রম করার সময় এতই দ্রুত এগিয়ে যাবে, মনে হবে এই বুঝি আপনাকে ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে নিচে। পাহাড়ি রাস্তা থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার ফুট নিচের চোখ ধাঁধানো মোলায়েম সবুজ দৃশ্য আপনার ভ্রমণে ভিন্ন আনন্দ যোগ করবে। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি ৪৬ কিলোমিটার দূরের ভ্রমণ। দু ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয় সেখানে পৌঁছাতে। টিকেট কেটে নীলগিরি মূল স্পটে পৌঁছানোর পর মনে হবে, পাহাড় ও মেঘের মাঝখানে দু হাজার ফুট উপরে আপনার ভ্রমণে আক্ষেপ তৈরি করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নীলগিরিতে বেলা ১১টার পর মেঘ চোখের সামনে কুয়াশার মতো উড়তে শুরু করেছিল। শরীর অতিক্রম করার সময় মনে হবে, হালকা শিরশিরে অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করবে, হাতের মুঠোয় করে কিংবা পকেটে ভরে এক টুকরো মেঘ বন্দী করে নিয়ে আসতে। পাহাড়ের বুকে মেঘের ভেলায় সাঁতার কাটার আগ্রহ জাগাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু, এই মেঘগুলো শুধু চোখে দেখা এবং অনুভূতিতে করেই রাখা যায়। একদম স্বচ্ছ একটা পরিবেশের সাক্ষী হওয়ার জন্য বান্দরবান যাওয়া উচিত। নীলগিরি থেকে চিম্বুক যাওয়ার পথে সীতা পাহাড়ের উপর তৈরী আসনগুলোয় বসে কয়েকটা ছবি অবশ্যই তুলবেন- সত্যিই আপনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে আছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
নীলগিরি থেকে চিম্বুক পাহাড়ের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সবাই আগে চিম্বুক পাহাড়ে ভ্রমণ করলেও আমরা প্রথমে নীলগিরি গিয়েছিলাম। কারণ, আমাদের একদিনের সফরে মূল লক্ষ্যই ছিলো নীলগিরি দর্শন। যা-ই হোক, চিম্বুক পাহাড়ে ওঠার সময় পুরো এলাকা মেঘের আবরণে ঢেকে গিয়েছিলো। ভিডিও কিংবা ছবিতে অনেকেই কুয়াশা ভেবে ভুল করতে পারেন। মেঘ একদম দৃষ্টি সীমানার নিকটে অবস্থান করায় টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো। এই বৃষ্টির মাঝে কিছুটা আতংক কাজ করলেও, দুয়েক মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর আপনি তা উপভোগ করতে শুরু করবেন। আমাদের সাথেও ঠিক তাই ঘটেছিল।
চিম্বুক পাহাড় থেকে আমাদের যাত্রা আবার শহরের দিকে। ঘড়িতে তখন প্রায় দুপুর দুটো বাজে। শহরে পৌঁছাতে আনুমানিক সাড়ে তিনটার কাছাকাছি বেজে থাকবে। পথে শৈলপ্রপাত পড়লেও তাতে এখন আর কিছুই নেই দেখার মতো। শীতকালে এই প্রপাত পানিবিহীন থাকে।
শহরে ফেরত যাওয়ার পথে ক্লান্তি নেমে এসেছিলো সবার মাঝে। একটু একটু করে ঝিমাচ্ছিলাম। পুরো রাস্তা জুড়েই মেঘ আমাদের সাথী হয়ে ছিল। মেঘের ভেতর দিয়েই আমাদের গাড়ি এগোচ্ছিলো। শহরে পৌঁছানোর পর আমাদের যাত্রা স্বর্ণমন্দিরের দিকে। পথেই সাঙ্গু নদীর অবস্থান। শীতকাল হওয়ায় সম্ভবত পানি একদম কম ছিল। স্বর্ণমন্দিরে জুতা পায়ে এবং হাফ প্যান্ট পরে ঢোকা নিষেধ। নাম স্বর্ণমন্দির হলেও সেখানে কোনো মূর্তি কিংবা স্থাপনায় স্বর্ণের ছিটেফোঁটাও নেই। অসংখ্য বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে সেখানে। প্রতিটির উপরে সৌরজগতের গ্রহের আলাদা আলাদা নাম দেওয়া ছিল।
মূল মূর্তির কাছে পূজারী ব্যতীত কারোই প্রবেশাধিকার নেই। মূর্তির স্থিরচিত্র নেওয়ার অনুমতি থাকলেও ভিডিও করার অনুমতি নেই দর্শনার্থীদের। কোনো তথ্য জানার থাকলেও সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভিক্ষুরা কিছুই জানায়নি। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরের জবাবে তাদের অনাগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছিল। তবে মন্দিরের উপর থেকে শহরের দৃশ্যটা বেশ দারুণ চোখে আসছিল। বান্দরবানে শহরের বালাঘাটায় ছোলামুড়ির আয়োজন ছিল রাস্তার উপর। আমরা সবাই এই ছোলামুড়ির ভক্ত, তাই না খেয়ে থাকতে পারিনি। বান্দরবান শহর অনেকটাই মফস্বল ধাঁচের। আমি যেন আমার শৈশবে ফেরত চলে গিয়েছিলাম।
সেখান থেকে ফিরে বাসস্ট্যান্ডে পূরবীর সন্ধ্যা ৬.৩০ এর সবশেষ বাসের চারটা টিকেটে কেটে রওনা দিলাম নীলাচলের উদ্দেশে। হাতে তখনো সময় প্রায় দেড় ঘণ্টারও বেশি। নীলাচল শহর থেকে মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, আর উচ্চতায় ১৬০০-১৭০০ ফুট উপরে অবস্থিত। মাগরিবের আযানের ১৫-২০ মিনিট আগে আমরা সেখানে পৌঁছাই। সন্ধ্যা নামার পূর্বমূহূর্তে নীলাচল পুরো অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল মেঘের আনাগোনায়। মেঘের অবস্থান এতটাই ঘন ছিল যে নীলাচলের দূরের প্রকৃতি খালি চোখে ধরা পড়ছিল না।
নীলাচলের দূরের আকাশ যতটুকু নজরে আসছিলো, মনে হচ্ছিল, মেঘ কোনো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো নতুন করে জেগে উঠছে। সবমিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের কমপক্ষে ৪০ মিনিট আগেই আমাদের সফর শেষ হয়ে গিয়েছিল। মাহিন্দ্রা গাড়ির ড্রাইভার আব্দুল করিম ভাইয়ের আতিথেয়তা ছিলো অসাধারণ। দারুণ একজন মানুষ তিনি। নীলাচল থেকে ফিরে বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডে আমাদের সবাইকে চা খাইয়েছিলেন তিনি। বাস ছাড়ার তখনও আধঘণ্টা বাকি ছিল। ক্লান্ত শরীরে তখন আমাদের বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ততক্ষণে বান্দরবান শহরে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পথঘাট ভিজে হাইওয়ে ভ্রমণের অনুপযুক্ত হয়ে ছিল। তাই বৃষ্টি আর জ্যামে একাকার হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায় আমাদের। দিনশেষে অনুভূতি ছিলো- দীর্ঘদিন পর স্বচ্ছ পরিবেশে নিঃশ্বাস নিয়ে অনেকদিনের শারীরিক ও মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো। প্রতি বছর তাই অন্তত কয়েকবার এমন ভ্রমণ জরুরি। ভ্রমণবিহীন আপনি আপনার ভেতরের সত্ত্বাকে জাগ্রত করতে পারবেন না। আপনার দৃষ্টি ও মেধাশক্তিকে সর্বোচ্চ প্রখর করতে পারবেন না। আপনি যত ঘুরে বেড়াবেন, তত আপনার আত্মবিশ্বাস দৃঢ়তর হবে।
No comments:
Post a Comment